পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া নদীর তীরে লাশের সারি ঘিরে আহাজারিতে আকাশ-বাতাশ ভারী হয়ে উঠেছে। গতকাল দুপুরে শুভ মহালয়া উদযাপন করতে যাওয়া তীর্থযাত্রীদের নৌকাডুবির পর এ লাশের সারি তৈরি হয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ডুবুরির দল নারী-শিশুসহ ২৪ জনের লাশ উদ্ধার করতে পেরেছে।
এ সময় পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন আরও অন্তত ৩০ জন। উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার খবরে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পেশাজীবী নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
এদিকে স্বজনদের খোঁজ নিতে অনেকেই নদীর পাড়ে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। শোকার্তদের আহাজারি চলছে বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও। জানা গেছে, অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার কারণেই নৌকাটি ডুবে যায়। দুপুরে পূজারিরা নদীর ওপারে অবস্থিত ঐতিহাসিক বদেশ্বরী মন্দিরে পূজায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নৌকাটিতে শতাধিক যাত্রী ছিল। মাঝনদীতে কাত হয়ে ডুবে যায়। যাত্রীরা চিৎকার করতে থাকেন। যারা সাঁতার জানতেন তারা কোনো রকমে ডাঙায় উঠতে পারলেও বাকিরা তলিয়ে যান। সন্ধ্যা পর্যন্ত যে ২৪ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়, তারা সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ।
পরে জেলা প্রশাসন, ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা ঘটনাস্থলে আসেন। প্রথম পর্যায়ে জেলা প্রশাসন জানায়, নদীর পানি থেকে ১৬টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকি ৮ জনকে আহত অবস্থায় বোদা সদর হাসপাতালে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদেরও মৃত ঘোষণা করেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন।
এ ঘটনায় মাডেয়া ইউনিয়ন পরিষদে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, রংপুর সিভিল ডিফেন্সের একটি ডুবুরি দল উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। রাতে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কাজ করতে পারবে ততক্ষণ এই উদ্ধার কার্যক্রম চলবে। আজও এই উদ্ধার কার্যক্রম চলবে।
এরই মধ্যে মৃতদেহ সৎকারের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর মহালয়ার দিনে বদেশ্বরী মন্দিরে বিশেষ পূজা-অর্চনার আয়োজন করা হয়। এই মন্দিরে দেশ-বিদেশ থেকে পূজারিরা মহালয়ার দিনে পূজা করতে আসেন।
মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট দিয়ে দীর্ঘকাল ধরে মানুষ পারাপার হচ্ছে। ওপারে দেবীগঞ্জ এবং এপারে বোদা উপজেলার কয়েক শ গ্রামের কয়েক লাখ মানুষের যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা এই ঘাট। এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন সহস্রাধিক মানুষ পারাপার হয়। আউলিয়া ঘাটে একটি সেতু নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার মানুষ দাবি জানিয়ে আসছে।
সর্বশেষ ২০২১ সালে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ঘাটটি পরিদর্শন করে একটি সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। আজও ওই ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়নি। ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পঞ্চগড় স্টেশনের সহকারী উপ-পরিচালক শেখ মাহবুবুল ইসলাম সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে জানান, আমরা ২৪টি লাশ উদ্ধার করেছি।
আমাদের ডুবুরি দলের সদস্যরা উদ্ধার কাজ অব্যাহত রেখেছে। তথ্যকেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, স্বজনদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ৩০ জনের নিখোঁজের তালিকা করা হয়েছে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে তারা হলেন- শ্যামলী রানি (১৪), লক্ষ্মী রানি (২৫), অমল চন্দ্র (৩৫), শোভা রানি (২৭),
দীপঙ্কর (৩), পিয়ন্ত (২.৫), রুপালি ওরফে খুকি রানি (৩৫), প্রমিলা রানি (৫৫), ধনবালা (৬০), সুনিতা রানি (৬০), ফাল্গুনী (৪৫), প্রমিলা দেবী (৭০), জ্যোতিষ চন্দ্র (৫৫), তারা রানি (২৫), সনেকা রানি (৬০), সফলতা রানি (৪০), হাশেম আলী (৭০), বিলাস চন্দ্র (৪৫), শ্যামলী রানি ওরফে শিমুলি (৩৫), উশোশি (৮), তনুশ্রী (৫), শ্রেয়শী, প্রিয়ন্তী (৮)।
বোদা থানার ওসি সুজয় বলেন, গত দুই দিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ফলে উজানের ঢলে নদীর পানি বেড়েছে। আর নৌকাটি ডুবেছে মাঝ নদী বরাবর। এতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে। পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোলেমান আলী জানান, লাশ শনাক্তের পর নিয়ম অনুযায়ী স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। নৌকাডুবিতে এ পর্যন্ত ২৪ জনের লাশ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে নারী ১২ জন, শিশু ৮ জন এবং পুরুষ ৪ জন রয়েছে।